নিউজ ডেস্ক:
মাত্র সপ্তাহখানেক স্থিতিশীল থাকার পর ফের অস্থির হয়ে উঠেছে চালের বাজার। পাইকারি পর্যায়ে মোটা-চিকন-মাঝারি সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি একশ’ থেকে দেড়শ’ টাকা। যার প্রভাবে খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি নতুন করে দাম বেড়েছে আরও দুই থেকে তিন টাকা। এ নিয়ে মিল মালিক, আড়তদার, পাইকার, বড় ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের মধ্যে চলছে একে অন্যের ওপর দোষ চাপানোর খেলা।
বড় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সিন্ডিকেটের অপ্রতিরোধ্য দাপটের কারণে আমদানির সুফল পাচ্ছেন না তৃণমূলের ভোক্তারা। মিল মালিকরা বলছেন, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আড়তে আড়তে অভিযান চালানো দরকার। পাইকাররা বলছেন, মিলগেটে নির্ধারিত দরের প্রভাব পড়ে খুচরা পর্যায়ে। তবে বাজার পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য, প্রতিটি স্তরে তদারকি না থাকায় বিভিন্ন পর্যায়ে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এ চক্রের দৌরাত্ম্যে সরকার অসহায়।
সম্প্রতি খোদ খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সরকারের অসহায়ত্বের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। পহেলা সেপ্টেম্বর রাজধানীর আজিমপুরে ছাপড়া মসজিদ প্রাঙ্গণে সারা দেশে শুরু হওয়া দরিদ্রদের মধ্যে স্বল্পমূল্যে চাল বিক্রি কর্মসূচির উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশে চালের বাজারে বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে সিন্ডিকেট আছে, তা ভাঙা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে তিনি সাংবাদিকদের সহযোগিতা চান।
সাংবাদিকদের উদ্দেশে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘মিলে কী দরে চাল বিক্রি হচ্ছে, সেখান থেকে আড়তে তারা কী দরে বিক্রি করছেন এবং আড়ত থেকে কিনে খুচরা বিক্রেতারা কত লাভে বিক্রি করছেন- তা মনিটর করার জন্য আপনাদের অনুরোধ করছি। মন্ত্রীর দাবি, দেশে চালের কোনো সংকট নেই, প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকালেই দেখা যায় প্রচুর পরিমাণ চাল আছে। এরপরও সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে, শুধু চালই নয়, আটা-ময়দা, ডিম, মাছ-সবজি ও প্রসাধনী সামগ্রীসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যেরই স্তরে স্তরে একাধিক শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। সরকার নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করেও তাদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে। এতে মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ীর পকেট দ্রম্নত ভারী হলেও অগ্নিমূল্যের ফাঁদে পড়ে নিম্ন-মধ্যবিত্ত চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে পড়েছে।
ব্যবসায়ীদের অনেকের ধারণা, ভুল পরিকল্পনার কারণে সরকার সিন্ডিকেট ভাঙতে ব্যর্থ হচ্ছে। যার খেসারত সাধারণ মানুষকে দিতে হচ্ছে। বাজার ব্যবস্থাপনায় গলদসহ নানা ফাঁক দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সময় অনৈতিকভাবে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। গোড়া থেকে সমস্যার সমাধান না করলে সরকার যতই উদ্যোগ নিক, সুফল মিলবে না।
তবে বাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদদের অভিমত, সরকারের নীতিতে কোনো ঘাটতি নেই। মূল ঘাটতি হচ্ছে বাস্তবায়নে। তাছাড়া সিন্ডিকেটবাজদের হাত অনেক লম্বা। এজন্য এদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে পলস্নীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ডক্টর কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে প্রথমেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করতে হবে। প্রয়োজনে আইন পরিবর্তন করতে হবে। এছাড়া সবক্ষেত্রে সরকারের তদারকি আরও বাড়াতে হবে।
এ সভাপতি বলেন, সরকার সিন্ডিকেট ভাঙার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের লোকবলের দুর্বলতাও এখানে অনেকটা দায়ী। আবার তদারকিতে ধরা পড়লেও বিচারিক ব্যবস্থার ঘাটতির কারণে অসাধু ব্যবসায়ীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। বিচারহীনতার একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। দেশ থেকে কারা টাকা পাচার করছে বা বাজারে কোন ব্যবসায়ী গোষ্ঠী কারসাজি করছে- তা সবার জানা থাকলেও এরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। আরও একটি বড় সমস্যা হচ্ছে, সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ব্যবসায়ীদের বসানো হয়েছে। বর্তমানে ব্যবসায়ী আর নীতিনির্ধারক মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। এটাও সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারার অন্যতম কারণ। কেননা ব্যবসায়ীরা তাদের গোষ্ঠীস্বার্থটাই আগে দেখবে বলে মনে করেন তিনি।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ডক্টর জাহিদ হোসেনের মতে, মাঝেমধ্যে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে জরিমানা করে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। অথচ সরকার দীর্ঘদিন ধরে এ কৌশলই কাজে লাগাচ্ছে। বিভিন্ন ধাপে ব্যবসায়ীরা কে কতটুকু লাভ করবেন তার সুস্পষ্ট নিদের্শনা বাস্তবায়ন জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া, ভ্যাট প্রত্যাহার, নিত্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এলসি (ঋণপত্র) মার্জিনের হার নূ্যনতম পর্যায়ে রাখাসহ বাজার তদারকি জোরদার করছে সরকার। এছাড়া ব্যবসায়ীদের কারসাজি ঠেকাতে সারা দেশে বাজারে তদারকি করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। পণ্য বেচাকেনায় পাকা রসিদের ব্যবহারে কড়াকড়ি আরোপ করেছে সংস্থাটি। কিন্তু বাজারে নিত্যপণ্যের দামে এসবের উলেস্নখযোগ্য কোনো প্রভাব পড়ছে না। বরং বাজারে বেশি মুনাফা লুটতে বাজার সিন্ডিকেট আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা এর আগে সয়াবিন তেল ও ডিম নিয়ে বাজার অস্থির করে তুলে অল্প সময়ে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এখন চাল-আটাসহ আরও বিপুল সংখ্যক পণ্য নিয়ে কারসাজি শুরু করেছে।
পর্যবেক্ষকরা জানান, চালের দাম বাড়ার জন্য বরাবরের মতো খুচরা আর পাইকারি ব্যবসায়ীরা মিলারদের দুষছেন। আর মিলাররা ভারতের চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা, শুল্ক বাড়ানো ও আবহাওয়াকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন।
জানা গেছে, রপ্তানিতে ভারতের অভ্যন্তরীণ সরবরাহ বৃদ্ধি করতে ভাঙা চাল (খুদ) রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত। একইসঙ্গে বাসমতি ও সিদ্ধ চাল ছাড়া অন্য চাল রপ্তানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে প্রতিবেশী দেশটি। মূলত আতপ চাল রপ্তানিতে এই শুল্ক বসিয়েছে ভারত। অথচ দেশের বাজারে সব চালের দামই বাড়ানো হয়েছে। পাইকারি বাজারে এখন মানভেদে সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৬ থেকে ৬৮ টাকা কেজি, যা খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৭২ থেকে ৭৫ টাকায়।
পাইকারিতে মাঝারি আকারের (পাইজাম, আটাশ, লতা) বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকা কেজি। ভোক্তারা খুচরা থেকে এই চাল কিনছেন ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা কেজিতে। আর পাইকারিতে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৪ টাকা কেজি, যা খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়।
রাজধানীর খিলগাঁওয়ের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, ভারতে চালের শুল্ক বাড়ানোর পরই নতুন করে মিলাররা দাম বাড়িয়েছেন। তারা ইসু্য খুঁজে পেলেই চালের দাম বাড়িয়ে দেন। বাজার কখনো স্থিতিশীল থাকে না। কাওরান বাজারের রহমত রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী এনামুল হক বলেন, চালের বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। গত সপ্তাহে দেশে চালের দাম কিছুটা কমেছিল। কিন্তু ভারতে শুল্ক বাড়ানোর পর আবার বেড়ে গেছে। মিলারদের কাছে সরকার জিম্মি হয়ে আছে। তাদের জরিমানা করা হয় না। ঢাকার বাজারে এসে সাধারণ ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা হয়। অথচ চালের মূল কারসাজি করেন মিলাররা।
তবে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এম লায়েক আলীর ভাষ্য, অযথাই তাদের ওপর দোষ চাপানো হয়। তারা ৬০ থেকে ৬১ টাকা কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি করছেন। কিন্তু খুচরা পর্যায়ে তা ১০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এই পার্থক্য কেন হয়। যারা পাইকারি বিক্রি করে তারা চালান দিয়ে বিক্রি করেন। এসব ব্যাপারে খোঁজ নিলেই জানা যাবে, কারা দাম বাড়াচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে কনজু্যমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া বলেন, ব্যবসায়ীদের মধ্যে মধ্যস্বত্বভোগী রয়েছে। এছাড়া মিল মালিকরাও চালের দাম বাড়ানোর পেছনে জড়িত। তারা ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছে আবার কিছুটা কমিয়ে দিচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে চালের দাম কমছে না। সরকার থেকে বেসরকারিভাবে চাল আমদানিকারকদের যে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে তা ভোক্তারা পাচ্ছেন না।
হুমায়ুন কবিরের ভাষ্য, সরকার মাঝেমধ্যে যে অভিযান চালায় তা নিয়মিত করা উচিত। কিন্তু তা মাঝেমধ্যে করার কারণে সিন্ডিকেটরা সুযোগ বেশি পান। সরকার চাইলেই সিন্ডিকেট ভাঙতে পারে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ডক্টর এমকে মুজেরি বলেন, যেকোনো ব্যক্তিগোষ্ঠীর হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা চলে গেলে ভোক্তার স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। তাই ভোক্তার সুরক্ষা দিতে হলে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের দরকার প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া। কিন্তু দেশে সেটি হচ্ছে না। কিছু ব্যক্তি-গোষ্ঠীর হাতেই নিত্যপণ্যের নিয়ন্ত্রণ। এরা কারসাজি করলে তখন সরকারের আর করার কিছু থাকে না। তিনি মনে করেন, মুক্তবাজার অর্থনীতি থাকবে। কিন্তু তার মানে এই নয়, এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা যা খুশি তাই করার সুযোগ পাবেন। বিশ্বের অনেক দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি থাকলেও সরকারের হাতে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও থাকে। বাংলাদেশেও এ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখতে হবে। এর জন্য দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর মনিটরিং সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।
বাজার মনিটরিংয়ে বড় ত্রম্নটি থাকায় নিত্যপণ্যের বাজার দিন দিন অস্থির হয়ে উঠছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর মীজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা বাজার মনিটরিং মানেই ভ্রাম্যমাণ আদালত ও জরিমানা করা বুঝি। কিন্তু এটাকে মনিটরিং বলে না। এতে কেবল কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ীর ক্ষতি হয়। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এর কোনো সুফল নেই। মনিটরিং হচ্ছে পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নজরদারি। আমাদের কাছে এ নিয়ে কোনো সঠিক পরিসংখ্যানই নেই। তা হলে সমাধান হবে কী করে। তাই আগে সরকারের কাছে এসব তথ্য থাকতে হবে।’
টিবি#