মোঃ আকতারুল ইসলাম : ‘ আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’, ভারত চন্দ্র রায় গুণাকারের অন্নদামঙ্গল কাব্যে ঈশ্বর পাটনী দেবী অন্নপূর্ণার কাছে নিজের স্বার্থ চিন্তা না করে সন্তানের মঙ্গল ও সমৃদ্ধির কথা ভেবে এ কথা বলেন। এ কথার মধ্যে নিজ স্বার্থ উপেক্ষা করে সন্তানের মঙ্গল কামনায় চিরন্তন মানসিকতাই মূখ্য হয়ে ওঠে। এ প্রার্থনা বাঙ্গালীর চিরন্তন মানসিকতা। আজও তার ব্যত্যয় নেই। সেই আদিকাল থেকে বাঙ্গালীর গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু সবচেয়ে সুখের বিষয় ছিল। আজ সে দিন বদলে গেছে। শুধু বাঙ্গালী নয় বিশ্ব গ্রামে প্রজন্মের জন্য মূখ্য হয়ে উঠে নিরাপত্তা ও সুস্বাস্থ্য।
ঢাকার রাজপথে লেগুনার পাদানীতে দিন যাপনকারী শিশুটির কাছে দুধ ভাত কিংবা অন্য কোনো খাবারই বড় নয়। তার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে জীবনের নিরাপত্তা। বিশ্বের আনাচে-কানাচে মানুষের মৌলিক অধিকার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা আর শিক্ষার মাঝে যোগ হয়েছে নিরাপত্তা। তৃতীয় বিশে^র দেশগুলো তা এশিয়া হোক আর আফ্রিকা হোক, কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলোই হোক, প্রাকৃতিক আর মানুষ্য সৃষ্ট সব প্রতিকূলতার প্রধান শিকার শিশুরা। আর এ দেশগুলোর এই ক্ষতিগ্রস্থ শিশুরা জীবন বাঁচাতে প্রথমেই গিয়ে দাঁড়ায় শ্রমের রাস্তায়। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে দারিদ্র্যের কারণে শিশুরা শ্রমিক হিসেবে পরিচিতি পায়, সংসারের হাল ধরে। শিশুরাই তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎকে পিষ্ট করে শ্রমের যাঁতাকলে। তার কাছে গৌণ হয়ে উঠে তার স্বাস্থ্য কিংবা নিরাপত্তার বিষয়। এমনই প্রেক্ষাপটে গত ১২ জুন বিশ^ব্যাপী পালিত হয়ে গেল বিশ্ব শিশু শ্রম প্রতিরোধ দিবস। আন্তজার্তিক শ্রমসংস্থা (আইএলও) এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘প্রজন্মের জন্য নিরাপত্তা ও সুস্বাস্থ্য’। আদিকাল থেকেই বিশ্বের সব দেশের শিশুশ্রম আছে, হয়তো থাকবেও, তবে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, সচেতন হচ্ছে শিশু শ্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষগুলো।
আন্তজার্তিক শ্রম সংস্থাকে শিশুশ্রম প্রতিরোধের উদ্যোগ নিতে হবে কিংবা জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে দিবস পালন করার প্রয়োজন হবে তা ৯০ দশকের আগে চিন্তাও করতে পারেনি। প্রজন্মের জন্য সব ধরনের শিশুশ্রম নিরসন উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেনি। আইএলও ১৯৯২ সালে প্রথম শিশুশ্রমের জন্য প্রতিরোধ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। সে মোতাবেক ২০০২ সালে প্রথম বারের মতো যারা বিশ্বে শিশুশ্রম প্রতিরোধে দিবস পালন করা হয়। শিশুশ্রম প্রতিরোধের বিষয়টি এর আগে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেনি। বিশ^ পরিস্থিতি পরিবর্তিত হচ্ছে। সেই সাথে বাংলাদেশও এগিয়েছে অনেক দূর। বিশ বছর আগেও শিশুশ্রমের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবার কথা মাথায় আসেনি। ২০০৩ সালে যেখানে বাংলাদেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ। পরবর্তীতে সরকারের নানামুখি উদ্যোগে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে প্রকল্প গ্রহণের ফলে লক্ষাধিক শিশু কারিগরি শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম থেকে প্রত্যাহার হয়। জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মানুষের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উন্নতির ফলে মাত্র ১০ বছরে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসে। ২০১৩ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরে্যর প্রতিবেদন অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত ১২ দশমিক ৮৩ লাখ শিশু। জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির কথা চিন্তা করে বাংলাদেশ ২০০১ সালে নিকৃষ্ট ধরণের শিশুশ্রম নিরসন সংক্রান্ত আইএলও কনভেনশন-১৮২ অনুসমর্থন করে। উক্ত কনভেনশনের বিধান (দফা-৪) অনুসারে অনুসমর্থনকারী দেশ সংশ্লিষ্ট মালিক ও শ্রমিক সংশোধনসমূহের সাথে আলোচনাক্রমে শিশুদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা কিংবা নৈতিকতার পক্ষে হানিকর কাজের তালিকা ও সময় নির্ধারণ করবে। সে পরিপ্রেক্ষিতে শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক বিকাশের পক্ষে অন্তরায় এমন কাজের তালিকা প্রণয়ের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এর আগে বর্তমান সরকার ২০১০ সালে যাবতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি ২০১০ প্রণয়ন করে। ঝুঁকিপূর্ণ খাতসমূহ সকল ধরনের শ্রম থেকে শিশুদের মুক্ত করে তাদের জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়ন করা এ নীতির উদ্দেশ্য।
পরবর্তীতে সরকার ২০১৩ সালে এক গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ৩৮টি কাজকে শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে নিষিদ্ধ করে। উক্ত ৩৮টি কাজ হচ্ছে অটোমোবাইল, ওয়ার্কসপ, বিড়ি-সিগারেটকারখানা, ইট-পাথর ভাঙ্গা, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপ, টেক্রটাইল, লেদ মেশিনেরকাজ, লবণ কারখানা, সাবান ও ডিটারজেন কারখানা, স্টিল, ফার্নিশার্স ও মটর গেরেজ, চামড়াজাতীয় দ্রব্যাদি বা ট্যানারিশিল্প, ওয়েল্ডিং বা গ্যাসবার্নার, কাপড়ের রং ব্লিচ, জাহাজ ভাঙ্গা, ভলকানাইজিং, জিআইসিট, চুনাপাথর, চকসামগ্রী, স্পিরিট ও আ্যলকোহল, জর্দা বা তামাক জাতীয়দ্রব্যাদি, সোনা বা ইমিটেশন, কাঁচ বা কাঁচের সামগ্রী, আতশবাজি, ট্রাক, টেম্পো বা বাস হেলপার, স্টেইনলেস স্টিল, কার্বন ফ্যাক্টরি, কসাইয়ের কাজ, কামারের কাজ, বন্দর বা জাহাজে মালামাল হ্যান্ডেলিং আ্যলুমিনিয়াম জাতীয় দ্রব্যাদি তৈরি, ম্যাচ ফ্যাক্টরি, প্লাষ্টিক বা রাবার তৈরি এবং কীটনাশক তৈরি রকারখানা এবং চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পকে শিশুশ্রম মুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর কর্তৃক ১১টি ঝুঁকিপূর্ণ যেমন এ্যালুমিনিয়াম, তামাক/বিড়ি, সাবান, প্লাষ্টিক, কাঁচ, পাথর ভাঙ্গা, সিল্ক, ট্যানারী, জাহাজ ভাঙ্গা এবং তাঁত শিল্পকে শিশুশ্রম মুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সম্প্রতি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় দেশের বড় চারটি বিভাগীয় শহরে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কি পরিমাণ শিশু কাজ করছে তার একটি জরিপ সম্পন্ন করেছে। আইএলও এর সহযোগিতায় প্রতিটি বিভাগীয় শহরে বিভাগীয় কমিশনারের সভাপতিত্বে জেলা প্রশাসক, ইউএনও, বিভিন্ন বেসরকারি এবং সামাজিক সংস্থার সমন্বয়ে জনসচেতনতামূলক সেমিনার করেছে। শিশুশ্রম নিরসনে জেলা, উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন করেছে। শিশুদের উন্নয়নে কাজ করে এমন সকল মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, এনজিওদের সমন্বয়ে জাতীয় কমিটি কাজ করেছে। শিশুশ্রম নিরসনে জাতীয় পরিকল্পনার স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘ মেয়াদী এই তিন ভাগে ভাগ করে সুনিদিষ্ট সময় সীমানির্ধারণ করা হয়েছে।
২০২১ সালের মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে অবশ্যই ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম এবং এসডিজি ৮.৭ অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে সকল প্রকার শিশুশ্রম নিরসন করতে হবে। সরকারও এ ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। এলক্ষ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রকল্পের চতুর্থ পর্যায়ে এসে বাংলাদেশের ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্পের আওতায় বাড়ছে। ইতিমধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) এ প্রকল্পটির অনুমোদন দিয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ২ লাখ শিশুকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ঝুঁকিমুক্ত জীবনে ফিরিয়ে আনা হবে। এরমধ্যে এক লাখ শিশু পাবে উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা আর এক লাখ পাবে কারিগরি প্রশিক্ষণ। সেই সঙ্গে প্রতিমাসে দেয়া হবে এক হাজার টাকা করে বৃত্তি। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। চলতি বছর থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এর আগে এ প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ খাতে নিয়োজিত ৯০ হাজার শিশুশ্রমিককে উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে এবং তাদের বাব-মাকে ক্ষুদ্র ঋণ দেয়ার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার আইএলওসহ বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক সংস্থা, বেসরকারি সংস্থা, মালিক সমিতি ও শ্রমিক সংগঠন এর সহযোগীতায় শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। আজকের যে শিশু-কিশোর তারাই হবে আগামীদিনে উন্নয়ন কৌশলের মূল চালিকাশক্তি। তাদেরকে উপযোগী করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের প্রচেষ্টা অবাহত থাকবে। ২০২৫ সাল পরবর্তী সময়ে শিশুশ্রম মুক্ত বাংলাদেশে শিশুর নিরাপত্তা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত হবে এ প্রত্যাশ্যা আমাদের সকলের।
(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)